Magic Lanthon

               

জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

ঋত্বিকমঙ্গল : অগোছালো মানুষের  গোছালো পাঠ

জাহাঙ্গীর আলম


ঋত্বিক ঘটক নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র নাগরিক মুক্তি পেয়েছিল তার মৃত্যুর এক বছর পর ১৯৭৭ সালে। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে চলচ্চিত্রটির সুরক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং একটি প্রিন্ট বের করা হয়। অগোছালো জীবনের এই মানুষটি নির্মাণ করেন আটটি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র আর বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। সুবর্ণরেখা তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলোর একটি, এটিও মুক্তি পাবার আগে তিন বছর পড়েছিল হিমাগারে। আর তার শেষ চলচ্চিত্র যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪) অনেক বাধা বিপত্তির পর প্রদর্শনের অনুমতি পায়।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ঋত্বিক নির্মাণ করেন তিতাস একটি নদীর নাম। মূলত এই চলচ্চিত্রকে ঘিরে এখানে ঋত্বিক-চর্চার সূত্রপাত। এর আগে ৬০’র দশকের শুরুতে এ অঞ্চলে তার মেঘে ঢাকা তারা প্রদর্শনের পর ব্যাপক আদৃত হয়েছিল। তবে  কিছু সমালোচনাও বেরিয়েছিল পত্র-পত্রিকায়। সব মিলিয়ে সেসময় এদেশে তৈরি হয় ঋত্বিক-চর্চার পটভূমি। বাংলাদেশে ঋত্বিক-চর্চার মোটামুটি সবকিছু আপনি এক মলাটে পাবেন ঋত্বিকমঙ্গল বইয়ে। এতে ২০০০ সাল পর্যন্ত ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে যাবতীয় লেখা অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেয়া ঋত্বিকের সাক্ষাতকার, তিতাস একটি নদীর নাম চলচ্চিত্রটি ঘিরে নানা আলোচনা-সমালোচনা, ঋত্বিক ঘটকের মূল্যায়ন বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মৃত্যু সংবাদ ও স্মৃতিচারণ, ঋত্বিক চর্চায় চলচ্চিত্র সংসদসমূহ, ভারতীয় হাইকমিশন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ।

ঋত্বিকমঙ্গল বইটি শুরু হয়েছে সাক্ষাতকার পর্ব দিয়ে। এখানে ঋত্বিক ঘটকের সাক্ষাতকার ছাড়াও তার চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অভিজ্ঞতা স্থান পেয়েছে। এছাড়া রয়েছে তার স্ত্রী সুরমা ঘটকের সাক্ষাতকার। এই পর্বে আপনি ঋত্বিকের চলচ্চিত্রে আগমন, শিল্পের আধুনিক এ শাখা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তি জীবনের নানা দিক সম্পর্কে জানতে পারবেন। শিল্পাঙ্গনের অনেকগুলো মাধ্যম পেরিয়ে ঋত্বিক ঘটক এসেছিলেন চলচ্চিত্রে। কলেজ জীবনে সাহিত্য চর্চার শুরু। পরে জড়িত হন নাটকের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত তিনি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন চলচ্চিত্রকে। তার ভাষায়, ‘কাল যদি একটি বেটার মিডিয়াম পাই, তাহলে আমি সিনেমা ছেড়ে চলে যাব।’ ২১ বছর বয়সে দেশভাগের কারণে পরিবারের সঙ্গে তিনিও পূর্ব বাংলা ছাড়তে বাধ্য হন। আজীবন এটি মেনে নিতে পারেন নি ঋত্বিক। দেশভাগের সঙ্গে দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাকে বিপর্যস্ত করেছে বারবার। তাই এসব বিষয়ই হয়ে উঠেছে তার চলচ্চিত্রের প্রধান উপজীব্য।

সাধারণের গ্রাহ্য হওয়ার চেষ্টা ঋত্বিক কোনোদিনই করেন নি। চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখেছেন - এমন দৃষ্টান্তও দেখা যায় না। তিনি বলেন, ‘যা কিছু জীর্ণ, শীর্ণ, যা কিছু সনাতন, পুরাতন সংস্কার, আমাদের অগ্রগতির পথ রোধ করে বসে আছে, তার বিরুদ্ধে আমার আপোসহীন সংগ্রাম। এর জন্য যা কিছু মূল্য দিতে হয় দেবো।’ তিনি দর্শককে ধাক্কা দিয়ে জাগাতে চেয়েছিলেন। দর্শককে প্রতি মুহূর্তে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, চলচ্চিত্রে যা দেখছেন তা একটি কল্পিত ঘটনা; কিন্তু এর মধ্যে যে থিসিসটা রয়েছে সেটা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি। সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যেই ঋত্বিক দর্শককে এলিয়েনেট করেন প্রতি মুহূর্তে। ঋত্বিক বলতেন, ‘আজ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছে ছাড়া অন্য কোনো দাবির কাছে আমি নতি স্বীকার করিনি। আমার যা ভালো লাগে, আমি তাই করি। আমি বিশ্বাস করি, আমার ভালো লাগাটাই আর দশজনের কাছেও ভালো লাগবে, কারণ আমি শিল্পী। সমাজের আর দশ জনের মন ও দৃষ্টি নিয়ে আমি সবকিছু প্রত্যক্ষ করি।’

তিতাস মানে তিতাস একটি নদীর নাম নির্মাণের আগে ১০ বছর সময় ধরে ঋত্বিক কোনো চলচ্চিত্র শেষ করতে পারেন নি। এমন একটি সময় বাংলাদেশের প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান ঋত্বিক ঘটককে দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্তটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলেন। ঋত্বিকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে হাবিব খানের (হাবিবুর রহমান খান) অভিজ্ঞতার বর্ণনাটা এমন- ‘কাজের সময় তিনি ভীষণরকম মনোযোগী এবং কাজের প্রতি একাত্ম হয়ে থাকতেন। তবুও মাঝে মাঝেই খামখেয়ালি হয়ে উঠতেন।’ ঋত্বিকের এই ‘অস্থিরতা’ নিয়ে স্ত্রী সুরমা ঘটকের মূল্যায়নটা গুরুত্বপূর্ণ; সুরমা বলেন, ‘ঋত্বিক দ্বৈত মানসিক সত্তার রোগে ভুগতেন।’ তবে বিশ্লেষকদের ধারণা, সুবর্ণরেখা তৈরির পর দীর্ঘদিন তার হাতে কোনো ছবি ছিল না। তখন মদ ছিল তার প্রধান সঙ্গী। ঠিক তখন তিনি একবার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং দীর্ঘদিন তাকে মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়। পরবর্তী সময়েও তার ওপর এসবের প্রভাব পড়ে। ঋত্বিকের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিতাস এর চিত্রগ্রাহক বেবি ইসলাম বলেন, ‘মানুষ ঋত্বিক ঘটক মাঝে মাঝে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, মনের দিক থেকে সম্পূর্ণ অস্থির থাকেন। তাই মাঝে মাঝে মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন।’

একটি সাক্ষাতকারে ঋত্বিককে একটি প্রশ্ন করা হয়- বাংলাদেশে ভাল চলচ্চিত্র হচ্ছে না কেন? বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গলদটা কোথায়? এর জবাবে ঋত্বিকের অকপট উত্তর, ‘আমার এ উত্তর জানা নেই। কারণ এতো ভালো করে জানিও না। আর এ কথা আলোচনা আমার কি করা উচিত?’ ঋত্বিক মনে করতেন, ভাল ছবির আন্দোলন, সত্যিকারের সৎ ছবির আন্দোলন বাণিজ্যিক ঘরানার বাইরে করতে হয়। পরে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রেও তার প্রভাব পড়ে এবং সেখানে আঘাত করার প্রশ্ন আসে। তিনি নিজেকে কখনো ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা বলে জাহির করার চেষ্টা করেন নি। বরং অত্যন্ত বিনীতভাবে ঋত্বিক তার কাজ ও সাফল্যকে বিচার করেছেন এভাবে- ‘কোনো চলচ্চিত্রকারই জনগণকে বদলাতে পারে না। জনগণ অত্যন্ত মহান। তারা নিজেরাই নিজেদের পরিবর্তন করে চলেছেন। আমি কেবল যেসব মহৎ পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে, সেগুলো ধারণ করে চলেছি।’

তিতাস একটি নদীর নাম মুক্তি পাওয়ার পর চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বেশ কিছু সমালোচনা প্রকাশিত হয়। অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি স্বার্থক হয়েছে, অনেকেই ঋত্বিকের এ প্রশংসা করেন। আবার কেউ তাকে উপন্যাসের মূল বক্তব্য এবং সামগ্রিক চিত্র দর্শকদের কাছে সুস্পষ্টভাবে উঠে আসে নি বলে অভিযোগ করেন। এর কারণ হিসেবে এক সমালোচকতো তার ভারসাম্যহীন অবস্থাকেই দায়ী করেন। এ ধরনের সব আলোচনা-সমালোচনা ঋত্বিকমঙ্গল বইয়ে স্থান পেয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বিদগ্ধ’ সমালোচকের প্রবন্ধের ওপর সাধারণ পাঠকের প্রতিক্রিয়াও বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে, যা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফলে ঋত্বিক ও তার চলচ্চিত্র সম্পর্কে একেবারে সাধারণ মানুষের ভাবনাটা জানার অবকাশ পাওয়া গেছে।

ঋত্বিকমঙ্গল বইটিতে মূল্যায়ন পর্বে সন্নিবেশিত হয়েছে ২৮টি প্রবন্ধ। অনেকগুলো প্রবন্ধে তার চলচ্চিত্রের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা রয়েছে। এর মধ্যে তিতাস নিয়েই আলোচনা সবচেয়ে বেশি। অনেকেই বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক দিকপাল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তার তুলনা করে আলোচনা করেছেন। সফদর হাসমী ‘দ্য জিনিয়াস দ্যাট ওয়াজ ঋত্বিক ঘটক’ প্রবন্ধে সমালোচকরা কীভাবে ঋত্বিককে দেখেছেন তা তুলে ধরেছেন। হাসমীর মতে, ঋত্বিক ঘটককে চূড়ান্ত কাঠামোবাদী এবং দুর্বোধ্য ও স্ববিরোধী ব্যক্তিত্ব বলে প্রচার করে তার মারাত্মক ক্ষতি করা হয়েছে। আর একদল সমালোচক এ মত প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন যে, চলচ্চিত্রকার হিসেবে ঋত্বিকের সংবেদনশীল মন তার চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তুকে তুলে এনেছে এক ধরনের সীমাবদ্ধ চিন্তা-চেতনার গণ্ডি থেকে; তার বুদ্ধিবৃত্তিক দায়বদ্ধতাই নাকি এই ধরনের বিষয়বস্তু নির্বাচনে তাকে বাধ্য করেছে। এসব চিন্তার নানা দিক নানাভাবে উঠে এসেছে ঋত্বিকমঙ্গল বইয়ের প্রতিটি লেখায়।

সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে চলচ্চিত্র শিল্প বর্তমানে চরম প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ও বিনিয়োগনির্ভর মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। নানা কারণে তরুণ প্রজন্ম চলচ্চিত্রের প্রতি এখন বেশ আগ্রহী। প্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষে অনেকেই নামমাত্র খরচে এখন চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। চলছে চলচ্চিত্রকে ঘিরে নানা জল্পনা-কল্পনা। একই সঙ্গে চলচ্চিত্রকে নিয়ে গড়ে উঠছে নানা আন্দোলন। এমন প্রেক্ষাপটে শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র-ভাবনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের এই এগিয়ে যাওয়ার পথে সব সময় সঙ্গী থাকবেন ঋত্বিক; কারণ তিনি ছিলেন তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

ঋত্বিকের মতো মহান পরিচালককে নিয়ে সাজেদুল আউয়াল ঋত্বিকমঙ্গল সম্পাদনা করে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। ঋত্বিকের সঙ্গে তিনিও এদেশে বেঁচে থাকবেন বহুকাল।

 

ঋত্বিকমঙ্গল, বাংলাদেশে ঋত্বিক-চর্চার দলিল : ১৯৭২-২০০০

সংগ্রহ, সম্পাদনা ও ভূমিকা : সাজেদুল আউয়াল

প্রকাশক : বাংলা একাডেমী, ঢাকা

প্রথম প্রকাশ : আষাঢ় ১৪০৮, জুন ২০০১

মূল্য : একশত ষাট টাকা

 

লেখকজাহাঙ্গীর আলম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ  সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। বর্তমানে দৈনিক বণিক বার্তায় সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত

alam_rumc05@yahoo.com

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন